মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়া একসময় ছিল ঐতিহ্য, সম্পদ ও স্থাপত্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে দেশটি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ সিরিয়াকে ঠেলে দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্যে। তেরো বছর পেরিয়ে গেলেও থামেনি রক্তপাত ও সংঘাত। গাজা, লেবানন, আর ইউক্রেনের যুদ্ধের উত্তেজনার মাঝে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে সিরিয়ার নাম।
সিরিয়ার ইতিহাসে আল-আসাদ পরিবারের নাম অবধারিতভাবে উল্লেখ করতে হয়। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সিরিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে এই পরিবার। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসেন। বর্তমানে টানা দুই যুগ ধরে (২৪ বছর) সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন বাশার।
সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে বাশার আল-আসাদের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ থেকে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের বেকারত্ব ও হতাশা থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেন বাশার। এর ফলে সংঘাত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সিরিয়ার সংকটে জড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি বিদ্রোহীরা সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দুই শহর আলেপ্পো ও হামার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর সঙ্গে অন্যান্য শহরের দখল নিয়েও এগিয়ে যায় তারা। বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) গোষ্ঠী। তাদের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি ঘোষণা করেছেন, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সম্প্রতি দামেস্ক ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তবে তিনি কোথায় গেছেন, তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
হাফিজ আল-আসাদের শাসনকাল
হাফিজ আল-আসাদকে আধুনিক সিরিয়ার রূপকার বলা হয়। ১৯৩০ সালে সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া এই নেতা আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন তিনি। প্রায় তিন দশকের শাসনকালে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৩ সালে মিসর-ইসরায়েল যুদ্ধে মিসরের পক্ষে দাঁড়ালেও পরে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। হাফিজ আল-আসাদের আমলে সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাঁর শাসনামলে সিরিয়া ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনের বিরোধিতা করে পশ্চিমা জোটকে সমর্থন দিয়েছিল।
২০০০ সালে হাফিজের মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেন।
বাশারের শাসনের শুরু
১৯৬৫ সালে দামেস্কে জন্ম নেওয়া বাশার আল-আসাদ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে ১৯৯৪ সালে তাঁর বড় ভাই বাসেল আল-আসাদের মৃত্যুতে সিরিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে বাশারের উত্থান ঘটে। বাবার নির্দেশে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে সামরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন তিনি।
৩৪ বছর বয়সে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে বসেন বাশার। শাসনামলের শুরুতে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন কর্তৃত্ববাদী শাসক। বিরোধী মতের প্রতি দমননীতির কারণে বিতর্কিত হয়ে ওঠেন তিনি।
আরব বসন্ত ও গৃহযুদ্ধ
২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় আঘাত হানে। বেকারত্ব, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে হতাশ জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাশার সরকারের কঠোর পদক্ষেপে বিক্ষোভ রূপ নেয় সংঘর্ষে। এতে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
গৃহযুদ্ধের ১৩ বছরে সিরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। দেশের অর্ধেক জনগণ গৃহহীন হয়েছে। মানবিক সংকটে জর্জরিত সিরিয়া বিশ্ববাসীর কাছে এক মর্মস্পর্শী উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাশারের শাসনে ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন থাকলেও তাঁর শাসনামল ঘিরে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব এবং মানবাধিকার সংস্থার তীব্র সমালোচনা। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার ও গণতন্ত্র দমনের অভিযোগে বাশার আজ এক বিতর্কিত নাম।
তথ্যসূত্র: এএফপি, বিবিসি, এনডিটিভি ও ব্রিটানিকা